ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

কার স্বার্থে লবণ আমদানীর তোড়জোড় ?

আতিকুর রহমান মানিক ::   মিল ও মাঠপর্যায়ে দেশীয় অপরিশোধিত লবনের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, যা দিয়ে অনায়সেই আগামী উৎপাদন মৌসূম পর্যন্ত চাহিদা পূরন করা যাবে। লবনের কোন ঘাটতি নেই। গত মৌসূমে উৎপাদিত প্রচুর অপরিশোধিত লবন মাঠে ও মিলে পর্যাপ্ত পরিমানে মজুদ আছে। অধিকন্তু আর মাত্র একমাস পরেই লবন উৎপাদনে মাঠে নামবেন কক্সবাজার জেলার লবন চাষীরা। এমতাবস্হায় কার স্বার্থে লবণ আমদানীর তোড়জোড় ? এ প্রশ্ন এখন লবন চাষী ও উদ্যোক্তাদের।

পর্যাপ্ত লবণ মজুদ আছে, এরপরেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে লবণ আমদানির পাঁয়তারা চালাচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু ফাঁড়িয়া চক্র। এরা নামসর্বস্ব “লবন মিল মালিক” নামে পরিচিত। কিন্তু কথিত এসব লবন মিলের কোনটা অস্তিত্বহীন, কোনটা প্যাড ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব, আবার কোনটা দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ, আর কোনটা অচল-ভাঙ্গাচোরা ও সংস্কারবিহীন অবস্হায় পড়ে রয়েছে। অথচ এসব মিলকে কাগজে কলমে সম্পূর্ন চালু ও উৎপাদনক্ষম দেখিয়ে লবন আমদানীর জন্য প্রতিবছর মাঠে নামে সংঘবদ্ধ ফাঁড়িয়া ও মধ্যসত্ত্বভোগী চক্র। অনেক দৌঁড়ঝাপের পর আমদানীর অনুমতি পেলেও এরা কিন্তু কখনো লবন আমদানী করেনা। বরং আমদানীর পারমিট ও কাগজ-পত্রাদি মোটা অংকের বিনিময়ে ঢাকা-খুলনা কেন্দ্রীক লবন মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আর তাদের পারমিট নিয়ে বিদেশ থেকে লবন আমদানী করে বাজার সয়লাব করে ফেলে ঢাকাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট। আর এতে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্হ হচ্ছে কক্সবাজারের লবন শিল্প ও লবন চাষীরা। সরেজমিন অনুসন্ধানে এ চিত্রই উঠে এসেছে।

লবন চাষী ও উদ্যোক্তারা জানান, গত কয়েকবছরের ধারাবাহিকতায় এবছরও লবন আমদানীর অনুমতি আদায় করতে মাঠে নেমেছে উপরোক্ত ফাঁড়িয়া ও পারমিটবাজ ভূয়া মিল মালিকদের অসাধু সিন্ডিকেট।

অথচ গত ২৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বিসিকের এক কর্মশালায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ‘এই মুহুর্তে লবণের সংকট নেই, অমদানি করা হবেনা” বলে ঘোষণা দেন।

কিন্তু অভিযোগ এসেছে, নিজেদের পকেটভারী  করতে আমদানিকারক উপরোক্ত ভূঁয়া মিল মালিক সিন্ডিকেট আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। এই ফাঁড়িয়া সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন গত সপ্তাহখানেক ধরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বহুমুখি তদবির চালাচ্ছে। দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে এরা। লবন শিল্পের উন্নয়ন প্রকল্প (বিসিক)’র তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিকটন অপরিশোধিত লবণ মজুদ আছে। কিন্তু লবন চাষিদের দাবী, ৫ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি লবণ মাঠে অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে ও কোন সংকট নেই।

কক্সবাজারের সিংহভাগ প্রকৃত মিল মালিক আমদানির বিপক্ষে। দেশের একমাত্র লবন উৎপাদনকারী জেলা কক্সবাজারে উৎপাদিত লবন দিয়েই দেশীয় লবনের চাহিদা পুরন করা হয়। প্রতিবছর (নভেম্বর-মে) শুস্ক মৌসূমে  কক্সবাজার জেলার ৮ উপজেলার প্রায় ৭০ হাজার একর উপকূলীয় জমিতে লবন চাষ করা হয়। এসব এলাকায় উৎপাদিত লবন প্রক্রিয়াজাতকরনের জন্য সদরের ইসলামপুর শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় ৬০ টি লবন কারখানা। স্হানীয় শিল্প উদ্যোক্তাগন ছাড়াও দেশের শীর্ষস্হানীয় শিল্পগ্রুপ এসিআই লিঃ, মোল্লা গ্রুপ, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিঃ, মেঘনা গ্রুপ, হীরা গ্রুপ ও উন্নয়ন সংস্হা ব্র্যাকের মালিকানাধীন এসব কারখানা পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০ ট্রাক (২ হাজার টন) পরিশোধিত লবন দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্তমানে ইসলামপুর থেকেই শিল্প ও ভোজ্য লবনের দেশীয় চাহিদার সিংহভাগ পুরন করা হচ্ছে। লবন আমদানী করা হলে স্হানীয় কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল এসব কারখানা ও শত শত কোটি টাকার  বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে।

বাংলাদেশ লবন চাষী সমিতির সদর উপজেলা শাখার সভাপতি হান্নান মিয়া  বলেন, বর্তমানে মাঠপর্যায়ে প্রায় ৪ লাখ টন অপরিশোধিত লবন মজুদ রয়েছে। ইসলামপুর লবন মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ বলেন,  কারখানাগুলোর গোডাউনে প্রায় তিরিশ হাজার টন লবন মজুদ রয়েছে। ইসলামপুর লবন মিল মালিক সমিতির অর্থ সম্পাদক ও মক্কা সল্ট ইন্ডাষ্ট্রীজ এর পরিচালক সেলিম উল্লাহ কাদেরী বলেন, আর মাত্র একমাস পরেই মাঠে উৎপাদিত নতুন লবন কারখানায় আসবে। গ্রামীণ সল্ট ইন্ডাষ্ট্রীর মালিক মোঃ তৈয়ব বলেন, মিলে ও মাঠে  মজুদকৃত লবন দিয়ে অনায়াসেই আগামী উৎপাদন মৌসূম পর্যন্ত চলবে। তাই এ মূহুর্তে লবন আমদানীর তৎপরতা  আত্নঘাতী ও দেশীয় লবন শিল্পকে ধ্বংস করার শামিল বলে জানান তারা।

এদিকে লবণের চাহিদা ও মজুদ নিরূপণের লক্ষ্যে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে বিসিক। গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিসিক মহাব্যবস্থাপক মোঃ মাজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান আহবায়ক ও বিসিক কক্সবাজারের লবণশিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচির উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরীকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।

কমিটির সদস্যরা হলেন- লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কায়ছার ইদ্রিস, কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি রইছ উদ্দিন ও ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ শামসুল আলম আজাদ। এদের মধ্যে শুধুমাত্র একজনই আমদানির পক্ষে বলে জানিয়েছে লবণ মিল মালিক ও চাষিরা।

চাষীরা জানান, কক্সবাজার উপকূলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি জমিয়ে সূর্যের কড়া রোদে পানি প্রক্রিয়াজাত করে লবণ তৈরি করা হয়। কক্সবাজার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা (আংশিক)সহ ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমি রয়েছে। ৫৫ হাজারের বেশি চাষি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লবণ উৎপাদন করে। কিন্তু দালাল, ফঁড়িয়া ও আমাদনির চক্রে বারবার ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হচ্ছেন  চাষিরা। মাঠ পর্যায়ে চাষিদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে লবণ কিনে অধিক মুনাফা করছে মধ্যস্বত্ত্বভোগি ও মিল মালিকরা। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অসাধু একটি চক্র। এরপর  সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে ভূল বুঝিয়ে বশে এনে লবণ আমদানি করে। এ বছরও আমদানির পাঁয়তারা চালাচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু মিল মালিক। অথচ আর একমাস পর থেকে পুরোদমে লবণ মৌসুম শুরু হচ্ছে।

মহেশখালী, চকরিয়া, ইসলামপুর, টেকনাফ, পেকুয়ার অন্তত ১০টি এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, এখানে মাঠপর্যায়ে প্রচুর পরিমাণ লবণ মজুদ আছে। উৎপাদনমূল্য না পাওয়ায় চাষিরা লবণ বিক্রি করছেনা। চাষিরা জানায়, যে লবণ গত এক মাস আগে বস্তাপ্রতি ৭৮০ টাকায় বিক্রি হতো সে লবণ বর্তমানে ৭০০ থেকে ৭২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হওয়ায় লবণের দাম নিম্নমূখী। বাজারে লবণের সরবরাহ ঠিক আছে। কোথাও ঘাটতি নেই।

সদরের ইসলামপুর শিল্প এলাকার মিল মালিকরা বলেন, ফঁড়িয়া ও ভূঁয়া মিল মালিকরা ছাড়া এ সেক্টর সংশ্লিষ্ট সবাই লবন আমদানীর বিপক্ষে। বিসিকের রিপোর্ট মতে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন লবণ জমা আছে। ঘাটতির কোন অশংকা নেই। এরপরও লবণ শিল্পের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবেনা।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ১৫ দশমিক ৭৬ লাখ মেট্রিকটন। এই মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৪ লাখ মেট্রিকটন। এ হিসাবে চাহিদার তুলনায় লবণের ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিকটন। সেই বছর ৫ লাখ মেট্রিকটন আমদানি বাদে ২ লাখ ৮৮ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত থাকে।

২০১৮ সালে ১৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিকটন লবণ চাহিদা ছিল। এই বছর ১৪ লাখ ৯৩ হাজার মেট্টিকটন লবণ উৎপাদন হয়। ঘাটতি থাকে ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্টিকটন। ২০১৭ সালের উদ্বৃত্ত ২ লাখ ৮৮ মেট্রিকটন বাদে বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিকটন লবণ চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত রয়েছে।

মহেশখালীর লবণ চাষি ও উদ্যোক্তা আমির খান বলেন, দেশে চাহিদা অনুযায়ী প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন ও মজুদ থাকার পরেও ফাঁড়িয়ারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে লবণ আমদানি করতে চাচ্ছে। লবন চাষী এনায়েত সিকদার বলেন, মাঠে প্রচুর অবিক্রিত লবণ আছে, যা মৌসুম পর্যন্ত চাহিদা পুরণ করে আরও বাঁচবে।

তবে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সভায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বক্তব্যে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, লবণ চাষি, মিল মালিক ও বিসিকের সমন্বয়ে মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।

এর প্রেক্ষিতে লবণের চাহিদা মজুদ নিরূপণে গঠিত ৫ সদস্যের কমিটির আহবায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান বলেন, মিল ও মাঠের তথ্য যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে বিসিককে বলা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে, দেশের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবেনা বলেও আশ্বাস দেন তিনি। কক্সবাজার লবণশিল্পের উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরী বলেন, মিল ও মাঠের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরী করা হচ্ছে।

স্বয়ং সম্পূর্ন দেশীয় লবন শিল্পকে রক্ষার্থে লবন আমদানীর মত আত্নঘাতী সিদ্ধান্ত না নেয়া ও ভূঁয়া মিল মালিক-ফাঁড়িয়াদের চিহ্নিতকরনে কমিটি গঠনের দাবী জানিয়েছেন কক্সবাজারের লবন চাষী ও উৎপাদনশীল লবন মিল মালিকরা।

পাঠকের মতামত: