ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

লামা ও আলীকদম ক্ষতিকর তামাক চাষের ভয়াল থাবা

নিজস্ব প্রতিবেদক, লামা-আলীকদম ::

বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলায় চলতি মৌসুমে প্রায় ১০ হাজার একর ফসলি জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষ হয়েছে। গত প্রায় তিন যুগ ধরে চলতি মৌসুমে উপজেলা দুটির ফসলি জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষের ভয়াল বিস্তারের কারণে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছেন স্থানীয় কৃষকেরা। এর ফলে উপজেলা দুটি চাষাবাদের দুই মৌসুমে পরিণত হয়েছে। একটি ধানের, অপরটি তামাকের। উপজেলা দুটির ফসলি জমিতে অব্যাহত তামাক চাষের ফলে একদিকে যেমন ফসলের বৈচিত্র্য কমেছে। অপরদিকে বোরো ও রবি শস্যের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, মাতামুহুরী নদীর পলিবাহিত উর্বর এলাকা এবং জ্বালানি কাঠের সহজলভ্যতার কারণে দেশের প্রধান প্রধান তামাক কম্পানিগুলো ১৯৮৪ সাল থেকে লামায় তামাক চাষ শুরু করে।

উপজেলার মেউলার চর এলাকায় প্রথম বছর ১০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়। এর পর থেকে গত ৩৫ বছরে ক্ষতিকর তামাক চাষের ভয়াল বিস্তার ঘটেছে লামা, আলীকদম ও পার্শ্ববর্তী বমু বিলছড়ি এলাকার বোরো ও রবি মৌসুমের ফসলি জমিতে।

লামা ও আলীকদম কৃষি বিভাগ সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে তামাক কম্পানিগুলো লামা উপজেলায় প্রায় ২ হাজার একর ও আলীকদম উপজেলায় প্রায় ১২০০ একর জমিতে তামাক চাষ করেছে। বেসরকারি হিসাব মতে এর পরিমাণ ৩ গুণ বেশি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তামাক কম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক সুবিধা হাসিলের লক্ষ্যে কৌশলগত কারণে কখনো তাদের রেজিস্ট্রেশনকৃত তামাক চাষির সংখ্যা ও জমির পরিমাণের প্রকৃত হিসাব জানায় না। তবে বিভিন্ন সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে লামা ও আলীকদম উপজেলার বিভিন্ন স্থানে দেশের বিভিন্ন তামাক কম্পানির আওতায় প্রায় ১০ হাজার একর ফসলি জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষ হয়েছে।

চলতি মৌসুম এলেই তামাক কম্পানিগুলো কৃষকদের বীজ, সার, কীটনাশক, পাওয়ার টিলার, পাওয়ার পাম্প, নগদ ঋণ, সর্বোপরি বাজারজাতকরণের সুবিধা প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। এর ফলে কৃষকরা চলতি মৌসুমে ফসলি জমিতে বোরো ও রবি শস্যের আবাদ না করে ক্ষতিকর তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

লামা ও আলীকদমের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনকালে কৃষকদেরকে ফসলি জমি এবং মাতামুহুরী নদীর দুপাড়ে ব্যাপকহারে তামাক চাষ করতে দেখা গেছে। উপজেলা দুটির আবাদি ফসলি জমিতে ব্যাপক হারে তামাক চাষের কারণে চলতি মৌসুমে বোরো ও রবি শস্য উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে লামায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫ হাজার ২৩ হেক্টর। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে বোরো এবং ৫৯০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭৮০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।

অপরদিকে আলীকদমে চলতি মৌসুমে বোরো চাষ ৭৭০ হেক্টর, রবিশস্য ১ হাজার ৫২২ হেক্টর, বাদাম চাষ ২৮৫ হেক্টর, শীতকালীন শস্য ৫৭০ হেক্টর, নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪৬০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। যদিও বিগত বেশ কয়েক বছর উপজেলা দুটির বোরো ও রবি শস্য উৎপাদন শুধু কৃষি বিভাগের কাগজে কলমে অর্জিত হয়ে থাকে।

জানা গেছে, লামা উপজেলার ৩০টি ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবং আলীকদমের ১৫টি ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। মাঠ পর্যায়ের এসকল কর্মকর্তাদের সাথে কৃষকদের সখ্যতা না থাকা, মাঠ পর্যায়ে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা, সর্বোপরি তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো কৃষকদের সামনে তুলে ধরার ব্যর্থতার কারণে এলাকার কৃষকেরা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছে বলে জানা গেছে।

একই সঙ্গে বাজারজাত করার নিশ্চিত সুবিধা ও তামাক চাষে কম্পানিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার কারণে স্থানীয় কৃষকেরা চলতি মৌসুমে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছে। ফসলি জমিতে ব্যাপক হারে তামাক চাষের ফলে এলাকায় বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। তিন দশক পূর্বে এলাকার পলিমাখা উর্বর জমিতে ফসল উৎপাদনে বৈচিত্র্য ছিল। বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন করে চলত এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা। বোরো ও রবি মৌসুমে একদিকে সোনালি ধানে মাঠ ভরে উঠত। অন্যদিকে, উৎপাদন হত গোল আলু, বেগুন, টমেটো, মরিচ, ফেলন, সিম, বাদাম, মিষ্টি কুমড়া, ক্ষিরা, সরিষা, পেঁয়াজ, বরবটি, কপি, মুগডাল ও মাসকলাইসহ বৈচিত্র্যময় নানান ফসল। এখন আর এ সকল ফসল উৎপাদন হয় না। মাঠজুড়ে শুধু তামাক আর তামাক। একসময় লামা ও আলীকদমে উৎপাদিত তরিতরকারি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হত। তামাকের আগ্রাসনের পূর্বে প্রতি কৃষকের ঘরে ধানের সাথে পুরো বছরের জন্য অন্যান্য খাদ্য ফসল মজুত করা হত। এর মধ্যে শুকনো মরিচ, আলু, রসুন, সরিষা, ডাল, সিম বিচি, পেঁয়াজ আদা, হলুদ ইত্যাদি ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে সবকিছুই চট্টগ্রাম ও চকরিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রয় করে স্থানীয় বাজারে বাজারজাত করতে হয়। সম্প্রতি এক বেসরকারি জরিপে দেখা গেছে, তামাক চাষের ফলে লামা ও আলীকদমের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ শাক-সবজি ও তরিতরকারি বাহির থেকে আনতে হয়।

লামা পৌরসভার কলিঙ্গাবিল এলাকার কৃষক মো. ইলিয়াছ জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ৫ কানি জমিতে তামাক চাষ করেছেন। তামাক চাষে কষ্ট ও পুঁজি বেশি হলেও লাভ বেশি। বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা আছে। বিক্রিলব্দ সমুদয় টাকা এক সাথে পাওয়া যায়। ছাগলখাইয়া এলাকার কৃষক, সাবেক পৌর কাউন্সিলর মো. শাহজাহান বলেন, ‘এ বছর আমি ২ একর জমিতে তামাক চাষ করেছি। বীজ, সার, কীটনাশক, পাওয়ার টিলার, পাওয়ার পাম্প, নগদ ঋণ প্রদান কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণপ্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদানসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা তামাক কম্পানিগুলো কৃষকদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে করে থাকে। সর্বোপরি উৎপাদিত তামাক কম্পানিগুলো ক্রয় করার নিশ্চয়তা দেয়। এসব কারণে কৃষকেরা চলতি মৌসুমে তামাক চাষ করেন।’

লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম জানান, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদেরকে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছর তামাক কিছুটা কম চাষ হয়েছে। তামাক চাষিরা কিছু কিছু সবজি চাষ ও ভুট্টা চাষ করেছেন। তামাক চাষে কৃষকদের অতি উৎসাহের কারণ এবং এর প্রতিকার চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে শিগগিরই একটি কর্মশালার আয়োজন করা হবে বলেও তিনি জানান।

লামা ও আলীকদমের ফসলি জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষের ভয়াল বিস্তার কমিয়ে চলতি মৌসুমের বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণসহ সার্বিক সহায়তা প্রদানে কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর বাস্তবমুখী উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

পাঠকের মতামত: