ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

মাতামুহুরীর ৩০ পয়েন্টে মানবসৃষ্ট চোরাবালি, অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু

মাতামুহুরী নদীর কক্সবাজারের চকরিয়া অংশে ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে 

মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, চকরিয়া ::
পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদী সরকার ঘোষিত কোনো বালুমহাল নয়। এর পরও এ নদীর কক্সবাজারের চকরিয়া অংশে শক্তিশালী ড্রেজার এবং শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে অসংখ্য স্থানে তৈরি হচ্ছে গভীর গর্তসহ চোরাবালি। মানবসৃষ্ট এ চোরাবালির কারণে নদীতে গোসল বা স্নান করা এখন বিপদসংকুল হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো স্থানে গোসল করতে নেমে সলিল সমাধি হচ্ছে মানুষের। গত এক বছরে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে এ মানবসৃষ্ট চোরাবালিতে।

দু’মাস ধরে মাতামুহুরী নদীর চকরিয়ার ঘুনিয়া, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, পৌরসভার বিভিন্ন পয়েন্ট, সাহারবিলের রামপুর, মাইজঘোনা, কৈয়ারবিল, বাঘগুজারা, বেতুয়া বাজার, কোনাখালীর কন্যারকুম, চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা, সওদাগরঘোনা, চরনদ্বীপ, বদরখালীসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে এখন চলছে প্রভাবশালী বালুদস্যুদের অপতৎপরতা। প্রভাবশালীরা এখানে শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু তোলায় সেখানে নতুন করে তৈরি হচ্ছে চোরাবালি। এতে নদীতে সৃষ্টি হচ্ছে ২০-৩০ ফুট গর্তসহ অসংখ্য চোরাবালি।

এ অবস্থায় মানুষ গোসল করতে নামলেই চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। এরই মধ্যে গত এক বছরে ২০ জনের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে চোরাবালিতে। কিন্তু বরাবরের মতোই প্রশাসনের কর্মকর্তারা রয়েছেন নির্বিকার। সম্প্রতি প্রভাবশালীরা মাতামুহুরী নদীর পূর্বকাকারা পয়েন্টে শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু তুলছে। এতে ওই পয়েন্টের একাধিক স্থানে গভীর গর্ত হয়ে চোরাবালির সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে সেখানে গোসল করতে নামে শিশু আমজাদ।

এ সময় সে চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়ে নিখোঁজ হয়। কিছুক্ষণ পর তার লাশ পানিতে ভেসে ওঠে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক বছরে চকরিয়ার বিভিন্ন স্থানে মাতামুহুরী নদীতে গোসল করতে নেমে অন্তত ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু। গত বছরের ১৪ জুলাই মাতামুহুরী নদীর চিরিঙ্গা সেতুর কাছের বালুরচরে ফুটবল খেলার পর গোসল করতে নদীতে নামে একদল স্কুল শিক্ষার্থী। তারা সবাই চকরিয়া গ্রামার স্কুলের শিক্ষার্থী।

ওই সময় মাতামুহুরী নদীর চোরবালিতে একে একে তলিয়ে গিয়ে প্রাণ হারায় পাঁচ শিক্ষার্থী। একটানা পাঁচ-ছয় ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে এবং চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরি দল এনে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। একসঙ্গে পাঁচ কিশোরের মৃত্যুর ঘটনায় পুরো কক্সবাজারে নেমে আসে শোকের ছায়া। সম্প্রতি উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর এলাকায় নদীতে গোসল করতে নেমে চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়ে নিখোঁজ হয় এক দোকান কর্মচারী। পরে চট্টগ্রাম থেকে ডুবুরি দল এসে তল্লাশি চালিয়ে নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। রামপুর পয়েন্টেও প্রভাবশালীরা শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু তুলছে।

এ কারণে সেখানে সৃষ্ট চোরাবালিতে প্রাণ যায় ওই দোকান কর্মচারীর। মাতামুহুরী নদীর তিন কিলোমিটারে ড্রেজিয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএস ন্যাশনের কর্ণধার নুরে বশির সয়লাব বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাকে নদীর তিন কিলোমিটারে ড্রেজিং করার জন্য নিয়োজিত করেছে। সে অনুযায়ী ডিজাইন করে তিনটি কাটার ড্রেজার মেশিন দিয়ে পরিকল্পিতভাবে কর বালু অপসারণ করছি। নদীর অন্যান্য পয়েন্টে যেসব শ্যালো মেশিন ও ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে আমার সম্পৃক্ততা নেই।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু তোলার কারণে নদীর বুকে বিভিন্ন স্থানে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয়ে চোরাবালিতে পরিণত হচ্ছে। এতে আগামী বর্ষা মৌসুমে নদীর তীর ভেঙে বহু স্থাপনা বিলীনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বালুদস্যুদের এ অপতৎপরতা বন্ধে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘মাতামুহুরী নদী থেকে বালু তোলার জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। যারা এ অপকর্ম করে নদীতে চোরাবালি সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

পাঠকের মতামত: